ঢাকা, শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৫৭ অপরাহ্ন

বিমানের ক্যাপ্টেন এনাম তালুকদারের বিচিত্র জীবন

enamবাংলাদেশ বিমানের ক্যাপ্টেন এনাম তালুকদার। সিনিয়র বৈমানিক এবং প্রশিক্ষক। বছরের প্রতিটি দিন আকাশপথে থাকার বিরল রেকর্ডের মালিক তিনি। কর্মজীবনে সর্বমোট চৌদ্দ হাজার ঘণ্টা আকাশপথে থাকার অভিজ্ঞতাও রয়েছে তার। জীবনের অনেকটা সময়জুড়ে যিনি কাটিয়েছেন আকাশপথে, তার জল এবং স্থলপথেও রয়েছে বেশকিছু বৈচিত্র্যময় কর্মকাণ্ড। বিভিন্ন পর্বতারোহণ, বঙ্গোপসাগরের সবগুলো দ্বীপে যাওয়া, মাছ ধরার ট্রলারে একটানা ১০ দিন ভ্রমণসহ, ফটোগ্রাফি করতে গিয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া, দৈনিক আট কিলোমিটার পায়ে হাঁটা, সপ্তাহে ১০০ কিলোমিটার সাইকেল চালানোর মতো গল্পগুলো জানাচ্ছেন আবদুর রহমান সালেহ-

ফটোগ্রাফির গল্প:

ঘটনা-১: বান্দরবানের জঙ্গল। জঙ্গলের ভেতরে বিরল প্রজাতির একটি পাখির ছবি তোলার জন্য ‘হাইড’ পেতে সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে দুপুর অবধি অপেক্ষা করছেন একজন ফটোগ্রাফার। মাঝে মাঝে বৃষ্টি নামছে। এরমধ্যে বিরল প্রজাতির পাখিটি দু’বার হঠাৎ করে দেখা দিয়ে পুনরায় হারিয়ে গেছে। পাখির ছবি তোলার সুযোগ পায়নি ফটোগ্রাফার। বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে ফটোগ্রাফারের হাইডের মধ্যে একটি সাপের উপস্থিতি দেখতে পেয়ে আচমকাই হৃৎপিণ্ড নড়ে উঠলো তার! ভয়ে জড়সড় ফটোগ্রাফারের মনে তখন জীবন রক্ষার তাগিদ। হাইডের এক কোণ উঁচু করে ধরতেই দৌঁড়ে পালিয়েছে সাপটি। ফটোগ্রাফারের ভাষায়, ‘সাপটা মনে হলো আমার থেকে বেশি ভয় পেয়েছে!’ সাপের ভয় কেটে যাওয়ার পর পুনরায় অপেক্ষা পাখির ছবি তোলার জন্য। অবশেষে দীর্ঘ অপেক্ষার পর অল্প সময়ের জন্য পাখিটি আসতেই এবার আর ক্যামেরার সাটারে ক্লিক করতে ভুল করেননি ফটোগ্রাফার। বাংলাদেশের দু’জন ফটোগ্রাফার বিরল প্রজাতির সে পাখির ছবি তুলতে পেরেছিলেন। একজন রোনাল্ড হালদার, পেশাদার ফটোগ্রাফার। অন্যজন এনাম তালুকদার, পেশাদার বৈমানিক, সৌখিন ফটোগ্রাফার।

ঘটনা-২: সুন্দরবনের গহীন অরণ্য। দেশি-বিদেশি ছয়জন ফটোগ্রাফার তুমুল আগ্রহ নিয়ে বাঘের ছবি তোলার অপেক্ষায়। অবশেষে সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে একটা সময়ে বাঘ এলো। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সাথেই শেষ হলো বাঘের ছবি তোলার পর্ব। ক্যামেরার লেন্স যখন বাঘের ছবি ধারণে ব্যস্ত, তখন নৌকায় উপস্থিত বাস্তবে প্রথমবার বাঘ দেখে ফটোগ্রাফারদের কারো কারো ভয়ে সেন্স হারানোর উপক্রম! দু’টি ঘটনাই এনাম তালুকদারের ফটোগ্রাফির অন্যতম বৈচিত্র্যময় অধ্যায়।

দ্বীপ ভ্রমণ: বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন সবগুলো দ্বীপ ভ্রমণের বৈচিত্র্য অভিজ্ঞতাও রয়েছে এনাম তালুকদারের ঝুলিতে। দ্বীপ ভ্রমণ করতে গিয়ে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখিও হতে হয়েছে যে, একটানা দশদিনের মত থাকতে হয়েছে মাছ ধরার ট্রলারে। সাগরের উত্তাল ঢেউ কখনো কখনো তৈরি করেছে অজানা আতঙ্কও। কিন্তু সখের কাছে উত্তাল ঢেউয়ের আতঙ্ক খুব বেশি ধোপে টেকেনি।

পর্বতারোহী: বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য পর্বতসমূহে বিচরণ করার পাশাপাশি নেপাল, ভারত, ইউরোপের অল্পসংখ্যক পর্বতসমূহেও বিচরণ করেছেন তিনি। ইচ্ছে ছিল মাউন্ট এভারেস্ট জয়েরও। কিন্তু বৈমানিক পেশার গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ক্যারিয়ার রক্ষার তাগিদে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ জয়ের সুযোগটা হয়ে ওঠেনি। উল্লেখ্য, প্রথম বাংলাদেশি এভারেস্টজয়ী মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট জয়ের শুরুটা হয়েছিল এনাম তালুকদারের হাত ধরেই। পর্বতারোহীদের সংগঠন নর্থ আলপাইন ক্লাবের একজন অন্যতম উপদেষ্টা এনাম তালুকদার।

দৈনিক জগিং: কোয়ান্টাম মেথডের একটি জনপ্রিয় স্লোগান আছে, ‘সুস্থ দেহ সুন্দর মন, কর্মব্যস্ত সুখী জীবন’। সব সুখের মূল স্বাস্থ্যকে ঠিক রাখতে প্রতিদিন সকালে জগিংয়ের অভ্যাস এনাম তালুকদারের দীর্ঘদিনের। এই অভ্যাসের ফলে এক সময়ে দৈনিক প্রায় দশ কিলোমিটারের জগিং পর্ব শেষ করতেন তিনি।

সাইক্লিং: বৈমানিক পেশার অন্যতম শর্ত সুস্বাস্থ্য। আর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সাইক্লিং এবং সাঁতার অন্যতম দুটো মাধ্যম হওয়ায় সাইক্লিং বেছে নিলেন এনাম তালুকদার। প্রথম আগ্রহ এবং আগ্রহের প্রয়োজন মেটাতে ধীরে ধীরে সাইক্লিংয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়লে সপ্তাহে ১০০ কিলোমিটার সাইকেল চালানো এক প্রকার নিয়মিত রুটিনেই পরিণত করেছেন তিনি। সে হিসেবে মাসে ৪০০ কিলোমিটার এবং বছরে ৪ হাজার কিলোমিটার সাইকেল চালানোর অভিজ্ঞতাও তার দখলে।

পরিচয়: এনাম তালুকদার বরগুনার আমতলী উপজেলার ঘটখালীর বিখ্যাত তালুকদার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা প্রয়াত আবদুল আজিজ তালুকদার। এনাম তালুকদার ১৯৮৬ সালে আমতলী একে পাইলট হাইস্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি, ১৯৮৮ সালে একই বিভাগে আমতলী কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমিতে ১৯৮৯ সালে ভর্তি হন। ১৯৮৯ সালে ট্রেইনি পাইলটের মাধ্যমে বৈমানিক পেশায় কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৯৫ সালে ক্যাডেট পাইলট এবং ১৯৯৬ সালে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য স্কটল্যান্ডের ব্রিটিশ অ্যারোস্পেস ফ্লাইং কলেজ থেকে ডিগ্রি নেন। বর্তমানে বাংলাদেশ বিমানের সর্বোচ্চ পদ ‘ক্যাপ্টেন’, সিনিয়র প্রশিক্ষক এবং প্রশাসনিক পদ হিসেবে ‘ডেপুটি চিফ অব ফ্লাইট সেফটি’ পদেও কর্মরত তিনি। এনাম তালুকদার দীর্ঘ কর্মময় জীবনে যেসব বিমান নিয়ে আকাশপথে ছিলেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- Flew PA-38 single engine Aero Plane, ATP twin turboprop, Fokker-28, Airbus-310, Dc-10 and Boeing 737-800 and total flying approx, 14000hrs প্রভৃতি।

স্বপ্ন: আকাশপথের রেকর্ড জয়ের পাশাপাশি জল এবং স্থলপথের বৈচিত্র্যময় কাজগুলোও সমানভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন এনাম তালুকদার। ক্যারিয়ারের বাকি সময়টুকুও এমনিভাবে অতিবাহিত করতে চান বৈমানিক পেশায় থাকা বৈচিত্র্যময় কাজ করে যাওয়া এনাম তালুকদার।

নিউজটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন