ঢাকা, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮:৪৬ পূর্বাহ্ন

মানুষ কেনার হাট

women-workerসকাল ৭টা, চারদিকে ঘন কুয়াশা, হু হু বাতাস শীতের তীব্রতা আরো বাড়িয়ে তুলেছে। পঞ্চগড় জেলা শহরের মোড়ে চোখ পড়ল বেশ কিছু মানুষের জটলার দিকে, কৌতূহলবশত মানুষের জটলার দিকে পা বাড়াই। কাছে গিয়ে জানতে পারি, এটি আসলে মানুষ কেনার হাট। এখানে দিনমজুর মানুষগুলো কাজের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। ক্রেতা আসবে, দরদাম হবে, দামে মিললে তার সঙ্গে কাজ করতে চলে যাবেন তারা। হাটে পুরুষের চেয়ে নারী শ্রমিকের উপস্থিতিই বেশি।

দিনমজুর মানুষগুলো ভোরে এখানে এসে অপেক্ষা করেন কাজের জন্য। এটি তাদের জন্য প্রতিদিনকার রুটিন। সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত চলে এই হাট। কথা হয় মনোয়ারা বেগম নামে ৬০ বছর বয়সি এক নারী শ্রমিকের সঙ্গে। বাড়ি পঞ্চগড় পৌরসভার পূর্ব ইসলামবাদ গ্রামে। মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমার বিয়ের বয়স যখন ছয় বছর তখন দুই সন্তান রেখে স্বামী অন্য জায়গায় বিয়ে করে। দুই সন্তান নিয়ে আমি হতাশার সাগরে ভাসতে থাকি। আমি তো মা। আমি সন্তান ফেলে যেতে পারিনি। আমার মায়ের কাছে সন্তানদের রেখে মানুষের বাড়িতে কাজ শুরু করি। এরপর এক মামা আমাকে এই হাটের কথা বলেন। এভাবে এই হাটে আসি আমি। দীর্ঘ ৩০ বছর এই হাট থেকে কাজে যাই, টাকা পাই, সংসার চালাই।’

মনোয়ারা বেগম আরো বলেন, ‘৩০ বছর আগে দৈনিক ৫ টাকা মজুরিতে কাজ শুরু করে এখন ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা মজুরি পাই। কোনোদিন কাজ পাই আবার কোনোদিন পাই না। যেদিন কাজ পাই না সেদিন বাড়ি ফিরে যাই। কাজ করে এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। ছেলে ছোট্ট একটা দোকান করে। দোকানের আয় দিয়ে সংসার চলে না। তাই কাজ নেওয়ার জন্য হাটে আসি। এখন বয়স হয়েছে আগের মতো ভারী কাজ করতে পারি না। ফলে অনেক সময় কাজ পাই না। পুরুষরা পায় ৪০০ টাকা আমরা পাই ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা। আমরাও পুরুষের সমান কাজ করি কিন্তু আমাদের দেয় কম টাকা। বর্ষায় তো কোনো কাজই পাই না। কোনো কোনো দিন এক বেলা খেয়ে দিন পার করতে হয়। বয়স্ক ভাতার কার্ডও নেই আমার।’

নারী শ্রমিক হালিমা বেগম (৫০)। হাটে এসেছেন কাজের সন্ধানে। জেলা শহরের কাছে রৌশনবাগ গ্রামে তার বাড়ি। ঘরে অসুস্থ স্বামীকে রেখে এসেছেন। অভাবের সংসার, ২০ বছর ধরে এই হাটে আসছেন তিনি। এখান থেকেই আয় করা টাকায় ২ মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়েটির বিয়ে হয়েছে মাসখানেক আগে। যৌতুকের ৪০ হাজার টাকা এখানো শোধ করতে পারেননি। শরীর না মানলেও মেয়ের সুখের কথা ভেবে প্রতিদিন ভোরে আসেন কাজের খোঁজে। হালিমা বেগম বলেন, ‘গরিবের মেয়ে বিয়ে দিতে মোটা অংকের টাকা লাগে। টেকা ছাড়া তো ছেলের বাপ কিছু বোঝে না।’

হাটে দাঁড়িয়ে কথা হয় মোমেনা বেগমের(৩৮) সঙ্গে। তার বাড়ি শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকায়। মোমেনা বেগম বলেন, ‘কাজ না করলে আমাদের মতো গরিব লোকেদের কে খাওয়াবো বাপু? কাজ করলে আমাদের ভাত জোটে। ছেলেটা ক্লাস ফাইভে উঠেছে। মেয়েটার বিয়ের বয়স হইছে, টাকার অভাবে বিয়ে দিতে পারি নাভ টেকা ছাড়া গরিবের মেয়ের বিয়ে হয় না।’

শাহিদা বেগম (৩৬) নামে একজন বললেন, ‘স্যার, আমাদের একটা কম্বল দিয়েন। এ বছর কেউ দেয়নি।’ হয়তো আমাকে ভেবেছে ত্রাণের কেউ। বাবলি বেগম নামে একজন বলেন, ‘এতো শীত এখানে রাতে ঘুমাতে পারি না। আমরা গরিব, আমাদের খবর কেউ রাখে না, শীতের কোনো কাপড় পাইনি এবার।’

উত্তরবঙ্গের এই মানুষগুলো লড়াই করছেন অভাবের সঙ্গে। শীতের তীব্রতা, গরমকালের অসহনীয় গরম- সব কিছু সয়ে পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য কাজের সন্ধানে প্রতিদিন তারা ছুটে আসেন এই হাটে শ্রম বিক্রি করতে।

নিউজটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

ট্যাগঃ