গৃহকর্মী মাহফুজা আক্তারের ডাক নাম হ্যাপি। গত সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে তাকে যখন ঢাকার রাস্তা থেকে উদ্ধার করা হয় তখন তার সারা শরীরে ছিল তীব্র আঘাত ও নির্যাতনের চিহ্ন, বাম চোখসহ মুখের একপাশ গুরুতর আহত এবং সে ক্রমাগত কাঁদছিল। বাংলাদেশে অসহায় গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা এর আগেও অনেক ঘটেছে কিন্তু মাহফুজার সাথে কথা বলে জানা গেল এক বিস্ময়কর তথ্য। কারণ সে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতো বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের নামকরা খেলোয়াড় শাহাদাত হোসেনের বাড়িতে এবং শাহাদাত ও তার স্ত্রী নৃত্য মিলে তার উপর করতো নির্মম নির্যাতন।
নির্যাতিত মাফুজার এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরে পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করেন পলাতক আসামি শাহাদাত হোসেন এবং তার স্ত্রী নৃত্য শাহাদাতকে। অবশেষে অক্টোবর মাসে শাহাদাতকে না পেয়ে যখন তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ তখন বাধ্য হয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন শাহদাত। শিশু নির্যাতনের দায়ে তারা দুজন পুলিশের হেফাজতে থাকলেও জামিন পেয়েছেন শাহাদাত। বর্তমোনে মামলাটি বিচারাধীন।
শাহাদাতের আইনজীবীরা যদিও বলছেন, হ্যাপি যখন ঘর থেকে পালিয়ে যায় শাহাদাত তখন বাসায় ছিলেন না, কাজেই তিনি নির্দোষ। তবে শাহাদাতের স্ত্রীর ব্যাপারে তারা কোনো মন্তব্য করেননি।
হ্যাপির সাথে কথা বলার পর বেরিয়ে এসেছে এক করুণ কাহিনী। শাহাদাতের বাড়িতে হ্যাপিকে কাজ করতে পাঠিয়েছিলেন তার নানি। সে জানে না তার বাবা-মা কোথায়। কিন্তু পরিবাররে অন্যদের টাকার প্রয়োজন মেটাতে তাকে কাজ করতে হয়েছে। হ্যাপি বলেছে, ‘আমার মামা কোনো কাজ করতো না এবং নানি ছিল অসুস্থ। টাকার প্রয়োজনে আমার কাজ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।’
শাহদাতের বাড়িতে কাজ করার সময় তাকে ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হতো এবং রাতে ঘুমাতে দেয়া হতো বাথরুমের ভেতর। সে বলেছে, ‘আমাকে তারা ঠিক মতো খাবার দিত না, শুধু ঘুমানোর আগে উচ্ছিষ্ট নষ্ট খাবার খেতে দিতো।’
আর সেইসাথে ভয়ানক শারীরিক নির্যাতন তো ছিলই। কাজেই ঘর থেকে পালানোর একটা পথ হ্যাপি অনেকদিন থেকেই খুঁজছিল। শাহাদাতের বাড়িতে আরেকজন ছুটা কাজের লোক ছিলেন। হ্যাপি ঠিক করেছিল যখন সেই লোক ঘরে ঢুকবে সেই ফাঁকে সে দৌঁড়ে পালাবে এবং শেষ পর্যন্ত সে ঠিক সেটাই করেছিল।
তবে ঘর থেকে পালিয়ে হ্যাপি ঠিকমতো দৌড়াতে পারছিল না, তাকে খোঁড়াতে হচ্ছিল। যে শারীরিক অবস্থা ছিল তাতে দৌড়াতে পারার কথাও নয়। সে বলেছে, ‘আমার সারা শরীরে তখন অসহ্য ব্যাথা করছিল। আমি যখন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন লোকজন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি হাত দিয়ে আমার বাম চোখ ঢেকে রেখেছিলাম কারণ এটা ফুলে গিয়ে ব্যাথা করছিল খুব। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে একপর্যায় আমি ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লাম রাস্তার পাশে।’
এরপর সেখানকার একজন স্থানীয় সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন হ্যাপিকে খুঁজে পেয়ে হাসপাতালে নিয়ে যান এবং পুলিশকে খবর দেন। বাংলাদেশ পুলিশের একজন ইন্সপেক্টর নজরুল ইসলাম সংবাদে জানান, মেয়েটি মারাত্মকভাবে আহত অবস্থায় ছিল এবং তার শরীরের বেশ কয়েকটি জায়গা আঘাতে দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল।
হ্যাপির এই নির্মম ঘটনা সমস্ত বাংলাদেশিদের জন্য ছিল আকস্মিক এবং বেদনাদায়ক। কারণ শাহাদত হোসেন ক্রিকেটের একজন জাতীয় নায়ক। ২৯ বছর বয়সী শাহাদাত ২০০৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলে বোলার হিসেবে যোগ দেন এবং এরপর থেকে তিনি ৩৬টি টেস্ট ম্যাচ এবং ৫১টি ওয়ানডে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি এখন পর্যন্ত একশোর বেশি উইকেটও পেয়েছেন। শুধু তাই না, তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র বোলার যার নাম ‘লর্ডস অনার বোর্ডে’ রয়েছে। এটা একজন ক্রিকেটারের জন্য অত্যন্ত সম্মানজনক। কিন্তু শাহদাত এবং তার স্ত্রী নৃত্য শাহাদাত অল্প বয়স্ক একটি বাচ্চা মেয়ে হ্যাপির সাথে যা করেছেন সেটা মানুষ হিসেবে অত্যন্ত অসম্মানজনক।
মাহফুজা আক্তার ওরফে হ্যাপি বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় নারী আইনজীবী সমিতির তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। সেখানে আরো কিছু নির্যাতিত শিশুদের বন্ধু হিসেবে পেয়ে সে ভালোই আছে। একসময় তার ভয় ছিল সে হয়তো কোনোদিন পূর্বের সেই ভয়াবহ অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে না। কিন্তু সে এখন একটি সুস্থ জীবনের স্বপ্ন দেখছে। তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল সে বড় হয়ে কি করতে চায়? প্রত্যুতরে সে বলেছে, ‘আমি স্কুলে যেতে চাই, কলেজে যেতে চাই এবং শেষে হতে চাই একজন নামকরা অভিনেত্রী।’