পাহাড়ের ঢালে হরিণের উৎসুক চাহনি। পাখির কলতান। নিশাচর বন্য শুকর-শিয়াল-বাঘডাসের বিচরণ। সজারু-কাঠবিড়ালিদের ছোটাছুটি। অজগর-গুইসাপের শিহরণ জাগানো উপস্থিতি। হরেক গাছের সমাহার। দুর্গম পাহাড়ের বুক চিড়ে ঝরনার ধারা। লেক আর পাহাড়ি ছড়ার শীতল পরশ। শাটলের ঝিকঝিক ছন্দ। ঝুলন্ত সেতুর রোমাঞ্চ। জারুলতলা-ঝুপড়ির আড্ডা। দিগন্তে পাহাড়ের সারি। উঁচু সবুজ প্রাচীরের মাঝে সূর্যের উদয়-অস্ত। প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের এমন মনমাতানো উপাদান সাজিয়ে সৌন্দর্যপিয়াসীদের নজর কাড়ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)।
সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে দেশের পর্যটন শিল্পে এতদিন নিজেকে উপস্থাপন করতে পারেনি প্রায় এক হাজার ৭০০ একর পাহাড়ি ভূমির উপর স্থাপিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই বিদ্যাপীঠ। ক্যাম্পাস পর্যটনের মাধ্যমে এসব সৌন্দর্য তুলে ধরতে এখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হাতে নিয়েছে বিভিন্ন স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। নতুন এ পরিকল্পনায় আছে নতুন করে লেক খনন, বৃক্ষরোপণ ও বন্যপ্রাণি সংরক্ষণের উদ্যোগ।
এ প্রসঙ্গে চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘ক্যাম্পাসভিত্তিক পর্যটনের সম্ভাবনা আছে এখানে। এই খাতের মাধ্যমে আয় বাড়াতে নানামুখী পদক্ষেপ হাতে নিয়েছি। এগুলো শেষ হলে পর্যটনের একটি অনবদ্য স্পট হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিচিত করতে হাটহাজারী উপজেলা কর্মকর্তার সাথে আলোচনা করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে সম্পূর্ণ একটি পরিকল্পনা পাঠাবো।’
ক্যাম্পাস পর্যটনের বিশ্বের বিভিন্ন বিদ্যাপীঠের উদাহরণ টেনে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এ বিশ্ববিদ্যালয় অনেক প্রাকৃতিক ও জীববৈচিত্র্যের আধার। আমাদের সম্পদগুলো অব্যবহৃত পড়ে আছে। বিশ্ববিদ্যালয় বছরে তিন মাস বন্ধ থাকে। তখন ক্যাম্পাসকে যদি পর্যটনের জন্য উন্মুক্ত করা যায় তাহলে তা ভ্রমণপিপাসুদের আরো আকৃষ্ট করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ও আর্থিকভাবে লাভবান হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী- এই ক্যাম্পাসে পাখি আছে প্রায় ১৫০ প্রজাতির। প্রজাপতি আছে প্রায় ১৪০ প্রজাতির। মৌমাছি, বোলতাজাতীয় পতঙ্গ আছে ৪৪০ প্রজাতির। এছাড়াও আছে আরও ৩৬৮ প্রজাতির উপকারি ও অপকারি কীট-পতঙ্গ। হরিণ, বন্য শুকর, শিয়াল, বাঘডাস, বানর, কাঠবিড়ালিসহ স্তন্যপায়ী পশু আছে প্রায় ২০ প্রজাতির। একটি অজগর, গুঁইসাপ, সাপসহ সরীসৃপ আছে প্রায় ২০ প্রজাতির। ব্যাঙসহ উভচর প্রাণি আছে প্রায় ১৫ প্রজাতির। প্রাণিদের উপর দেহাবয়ব সংগ্রহশালা আছে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে যা প্রাণিপ্রেমিকদেরও জ্ঞানের খোরাক পূর্ণ করবে।
চবি প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. বদরুল আমিন ভুঁইয়া বলেন, ‘আমাদের ক্যাম্পাসে এখনও অনেক প্রজাতির কীট-পতঙ্গসহ এমনসব প্রাণি আছে যা এখনো আমাদের অজানা। এই পতঙ্গ ও প্রাণিদের অধিকাংশই উপকারি।’ একই বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ আহসান বলেন, ‘প্রাণিদের বাস উপযোগী পরিবেশ আছে আমাদের ক্যাম্পাসে। তবে ক্যাম্পাস ট্যুরিজমের বিষয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নের সময় যেন প্রাণিদের ক্ষতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’
বন ও পরিবশেবিদ্যা ইনস্টিটিউট এবং উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ক্যাম্পাসে ৬০০ একর জায়গার মধ্যে সৃজিত বন আছে। এছাড়া পাহাড় ও পাহাড়ি বন আছে আরও ২৫০ একর জায়গার মধ্যে। ১৫০ একর ভূমির উপর একটি উদ্ভিদ উদ্যানও আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে লেক আছে ২৫টি। বড় বড় পুকুর আছে পাঁচটি। এছাড়া সবুজ পাহাড়ের বুক চিড়ে ছড়া-ঝরনাতো আছেই।
প্রকৃতির এই স্বর্গরাজ্যে আসার যানবাহনগুলোর মধ্যে আকর্ষনীয় শাটল ট্রেন। পুরো বিশ্বে একমাত্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েই শাটল ট্রেনের ব্যবস্থা আছে। এই শাটলই চবির শিক্ষার্থীদের হৃদযন্ত্র। শাটলে কোরাস গেয়ে দেশের সঙ্গীতাঙ্গন উজ্জল করেছেন নকীব খান, পার্থ বড়–য়া, এস আই টুটুলসহ অনেকেই। বছরখানেক আগে এই শাটলের সাথে যুক্ত হয়েছে ডেমু ট্রেন। চট্টগ্রাম নগরী থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নে ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশের সবচেয়ে বড় এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর একপাশেই আছে নোবেল জয়ী গ্রামীণ ব্যাংকের আঁতুরঘর জোবরা গ্রাম।
ক্যাম্পাসে ঢুকতেই জিরো পয়েন্টে আছে ‘স্মরণ’। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাদের স্মৃৃতিতেই নির্মিত এই সৌধ। এছাড়া ক্যাম্পাসে আছে বুদ্ধিজীবী চত্বর, শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক মানুষদের স্মরণে নানা আয়োজন। এছাড়া চবি গ্রন্থাগার জাদুঘরে আছে পাল, সেন, গুপ্ত, সুলতানি, মোঘলসহ বিভিন্ন আমলের প্রায় দুই হাজার ১৭টি নিদর্শন যার মাধ্যমে প্রাচীন হরিকেল জনপদকে চিনতে পারবে দর্শনার্থীরা। প্রাণিবিদ্যা বিভাগে আছে বিভিন্ন প্রাণিদের অবয়ব প্রদর্শনী। এছাড়া প্রায় তিন লাখ পুস্তকে সমৃদ্ধ চবি গ্রন্থাগার। বিশ্বশান্তি প্যাগোডার সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিন ভিড় করে শতশত শিক্ষার্থী এবং স্থানীয়রা।
সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের বাম দিকে ভিসি লেকের উপর স্থাপিত লাল-হলুদ রঙে রাঙানো ঝুলন্ত সেতুটিতে আছে রাঙ্গামাটির একটু ছোঁয়া। দৃষ্টিনন্দন ফরেষ্ট্রি এলাকার সবুজ বনায়ন ক্যাম্পাসকে আরও আকর্ষণীয় করেছে। ৫০ একর ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত এই এলাকায় রয়েছে হেলিপ্যাড, লেক, সুইমিংপুল, মেমোরিয়াল গার্ডেন। কলা ভবনের পিছনের ঝরনাও পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষনের স্পট। জীবনের যান্ত্রিকতা ভুলাতে উদ্ভিদ উদ্যান, জারুলতলা, সুনামি গার্ডেন এবং ঝুপড়িতে বসা আড্ডার জুড়ি নেই।
লোক প্রশাসন বিভাগের সদ্য মাস্টার্স করা নুরুল আলম বলেন, ‘ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তেমন ব্যবস্থা নেই। ফলে এই নজরকারা প্রকৃতি অনেকাংশে নষ্ট ও দূষিত হচ্ছে। জীববৈচিত্রেও এর প্রভাব পড়ছে।’ নিরাপত্তার অপ্রতুলতাকে ক্যাম্পাস ট্যুরিজমের অন্তরায় বলে মনে করেন যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী কামরুন নাহার সানজিদা।
চবি প্রক্টর মো: আলী আজগর চৌধুরী বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে কয়েকটি লেক পুনঃখননের উদ্যোগ নিয়েছি। পাহাড়ের ঢালে এবং পতিত জমিতে আরও বনায়নের কাজ চলছে। এছাড়া ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা আগের চেয়ে জোরদার করা হয়েছে।’ এছাড়া জীববৈচিত্র ও ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য রক্ষায় বিভিন্ন পয়েন্টে লাগানো সচেতনতামূলক সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। ক্যাম্পাসের প্রকৃতি রক্ষায় আলাদা একটি কমিটিও কাজ করছে বলে জানান এই শিক্ষক।
লেখক- তারেক মাহমুদ