বাংলার নারীরা এখন শুধু করপোরেট কিংবা স্কুল-কলেজেই নয় আকাশে যেমন শান্তির পায়রা ওড়ান তেমনই উত্তাল সমুদ্রও পাড়ি দেন। তারা হাজার নর্টিক্যাল মাইল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিশ্বের বড় বড় বন্দরে নোঙর করাচ্ছেন লাল-সবুজের পতাকাবাহী জাহাজগুলোকে।
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) অত্যাধুনিক এসব জাহাজ শুধু পণ্য পরিবহন-ই নয়, বিশ্বজুড়ে বার্তা দিচ্ছে বাংলার নারীদের অগ্রযাত্রার গৌরবগাঁথা, নারীর ক্ষতায়নের কথা।
বিএসসি সূত্র জানায়, সংস্থাটির ‘এমভি বাংলার জয়যাত্রা’, ‘এমভি বাংলার অর্জন’, ‘এমটি বাংলার অগ্রযাত্রা’ নামের তিনটি বড় জাহাজে ১৭ জন নারী অফিসার ও ক্যাডেট রয়েছেন। বহরে যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় থাকা ‘এমটি বাংলার অগ্রদূত’ জাহাজের জন্য তৈরি রয়েছেন আরও ছয়জন নারী ক্যাডেট ও অফিসার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব জাহাজে কর্মরত কর্মকর্তাদের মাসিকভিত্তিতে এবং ক্যাডেটরা দৈনিকভিত্তিতে তাদের ভাতা পান। যা বেশ সম্মানজনকও বটে। এর বাইরে জাহাজে ওঠার জন্য চীন যাওয়ার ফ্লাইট ভাড়া, কর্মরত থাকাবস্থায় থাকা-খাওয়া, ইউনিফর্মসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র বিনামূল্যে পান তারা।
মেরিটাইম আইন অনুযায়ী, সমুদ্রে জাহাজে কর্মরতদের প্রত্যেকের ইন্স্যুরেন্স রয়েছে এবং রয়েছে প্রোটেকশন অ্যান্ড ইনডেমনিটি (পিঅ্যান্ডআই) কাভারেজও।
বিএসসির মহাব্যবস্থাপক ক্যাপ্টেন জামাল হোসাইন তালুকদার বলেন, এছাড়া বন্দরে অবস্থানকালে ক্যাডেট ও কর্মকর্তারা ইন্টারনেটের আওতায় থাকলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ই-মেইল ও টেলিফোনে পরিবারের সদস্যদের কুশল জানতে পারে। যে কোন জরুরি মুহূর্তে স্যাটেলাইট ফোনে জাহাজ থেকে স্বজনদের সঙ্গে কথাও বলতে পারেন তারা ।
তিনি বলেন, ‘বাংলার মেয়েরা এখনও সব ক্ষেত্রেই ভালে করছে। আকাশ, সমুদ্রসহ অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও তারা বেশ সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। এটা নারীর ক্ষমতায়নেরই একটি প্রতীক।’ বিএসসি’র তিনটি নতুন জাহাজ বিশ্বের বিভিন্ন বন্দর ও সমুদ্রে অবস্থান করছে। এসব জাহাজে কর্মরত আমাদের নারী অফিসার ও ক্যাডেটরা সব চ্যালেঞ্জ জয় করে সততা, পেশাদারিত্ব ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।
এক প্রশ্নের উত্তরে ক্যাপ্টেন জামাল বলেন, বর্তমান সরকারের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমুদ্রগামী জাহাজে সাহসী নারীরা কাজ করে তাদের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ পেয়েছেন। এটি একটি বড় মাইলফলক।
‘বাংলার জয়যাত্রা’ জাহাজে রয়েছেন ক্যাডেট আতিয়া সৈয়দা, আনজুমান আরা, সৈয়দা সাবরিনা বাবুর, সোহানা পারভিন ও শতাব্দী হোসাইন। আর ‘বাংলার অর্জন’ জাহাজে চীনের সাংহাই থেকে উঠেছেন থার্ড অফিসার বিউটি আক্তার, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার লাভলী দাস, ক্যাডেট মৌটুসি তালুকদার বৃষ্টি, ইসরাত জাহান সেতু, তাসনিমুল বাহার ও সাজিয়া আফরিন। বেশ দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন তারা।
‘বাংলার অগ্রযাত্রা’য় নিয়োগ পেয়ে বর্তমানে চীনে অবস্থান করছেন ফোর্থ অফিসার ফারজানা আক্তার ফাইজা, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার খাদিজা আক্তার, ক্যাডেট কানিজ ফাতেমা, মেমি আফরোজা, নাফিসা আহমেদ নোভা ও ফারজানা ইয়াসমিন।
চলতি মাসেই বিএসসির বহরে যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে ‘এমটি বাংলার অগ্রদূতে’র। এ জাহাজে নিয়োগের জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে ক্যাডেট সানজিদা করিম মুমু, বিলকিস আক্তার, আয়েশা সিদ্দিকা এলিনুর, সাবিনা ইয়াসমিন, সুস্মিতা দাস ও রিক্তা আজিজকে। প্রশিক্ষণে বেশ দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন তারা।
তাদের একজন মেরিন একাডেমির ৪৯তম ব্যাচের ক্যাডেট সানজিদা করিম মুমু। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ২০১৪ সালের অর্থাৎ ৪৯ তম ব্যাচের ক্যাডেট আমরা। নারী ক্যাডেটদের এটি দ্বিতীয় ব্যাচ।
‘বিএসসি’র জাহাজে আমাদের এক বছরের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের সুযোগ দিলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজ করার সুযোগ মেলেনি। পরিবারের সদস্য, অভিভাবক ও স্বজনরা প্রেরণা দিয়েছেন, আমাদের শিক্ষকরা সাহস দিয়েছেন। আজ আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে।’
আরেক ক্যাডেট রিক্তা আজিজ বলেন, ক্যাডেট হিসেবে বেশ পরিশ্রম করে এই পর্যায়ে এসেছি। এখন যোগ্যতা প্রমাণের অপেক্ষায় আছি। কাজটা চ্যালেঞ্জের হলেও আমরা সমুদ্রেও জয়ী হবো।
এ বিষয়ে মানবাধিকার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, নারীরা বাইরে বেরিয়ে আসছেন এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। তবে সমতা এখনও নিশ্চিত হয়নি। একদিকে নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ পুরস্কার পাচ্ছে, অন্যদিকে যত্রতত্র যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারী। কারণ, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না আমরা। ফলে ক্ষমতায়নের সুফল পাচ্ছেন না নারী। তবে, স্থলে, আকাশে এবং সমুদ্রে নারীদের সাফল্যের প্রমাণ বেশ ভালো খবর বলেই মনে করেন এই নারী নেত্রী।
লেখক- তাসলিমা সুলতানা