সামিনা নাজ রূপা। জীবনের শুরুটা বাবার আদরের ছোট্ট মেয়ে হয়ে। বাবার স্বপ্ন পূরণে পরিশ্রম করে গেছেন প্রতিটি ক্ষেত্রে। আর তারই স্বীকৃতিস্বরূপ আজ তিনি ভিয়েতনামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত।
সামিনার বাবা এস এম আফজালুর রহমান ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা। দুই ছেলের চেয়ে কম করে কখনো দেখেননি ছোট্ট সামিনাকে। বাবার কাছ থেকেই সামিনার মনে বিসিএস নিয়ে চিন্তার শুরু। সামিনার ভাষায়, ‘বাবার ইচ্ছে ছিল আমি যেন পড়াশোনা শেষ করে বিসিএস দেই। এই চিন্তা আমি যখন সেভেন-এইটে পড়ি তখন থেকেই তিনি আমার মাথায় ঢুকিয়েছেন।’
স্কুল-কলেজ থেকে পাওয়া শৃঙ্খলা ও সততা নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান সামিনা। তবে বিষয় ঠিক করতে পারছিলেন না। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা নিয়ে পড়া আর সাংবাদিকতা করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল মনের মাঝে। কিন্তু মনে পড়ল বাবার স্বপ্নের কথা। নানাদিক ভাবার পর মনে হলো, সাংবাদিকতা করে নিজের ইচ্ছা পূরণের চেয়ে বাবার স্বপ্ন পূরণের আনন্দ অনেক বেশি। তাই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকেই অনার্স, মাস্টার্স সেরে ১৫ তম বিসিএসের জন্য আবেদন করেন সামিনা। ১৯৯৫ সালে পররাষ্ট্র ক্যাডারে কাজে যোগ দেন তিনি।
দেশের বাইরে কর্মজীবনের শুরু নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশ দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি হিসেবে। সেখান থেকে বাংলাদেশে ফিরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কিছুদিন। এরপর তাকে ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় নিউইয়র্কে জাতিসংঘের স্থায়ী মিশনের থার্ড কমিটির বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে। সাড়ে তিন বছর সামাজিক ও মানবাধিকার ইস্যু দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে কাউন্সিলর পদে প্রমোশন পান। এরপর তাকে একই পদে দিল্লিতে পাঠানো হয়।
মমতার টানে ঘরে ফেরা: কিন্তু দিল্লিতে পৌনে তিন বছরের মতো কাজ করে সামিনা বাংলাদেশে ফিরলেন। মা হতে যাচ্ছিলেন তিনি। ‘এ কারণেই আমি প্রথমে পরিচালক হিসেবে, এবং পরে মহাপরিচালক হিসেবে প্রায় সাত বছর ঢাকায় ছিলাম। তখন আমি চেয়েছিলাম পরিবারকে বেশি সময় দিতে,’ বলেন সামিনা।
দেশে ওই অবস্থায়ই নিষ্ঠার সাথে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করেছেন সামিনা নাজ। এমনকি জমজ সন্তান জন্ম দেয়ার দশ দিন আগ পর্যন্তও তিনি অফিস করেছেন। এমন শারীরিক অবস্থায় কাজ করাটা খুবই কষ্টের মন্তব্য করে সামিনা বলেন, ‘কিন্তু আমার স্বামী ও সহকর্মীরা ছিলেন অনেক বেশি সাপোর্টিভ। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তার সহধর্মিনীও ছিলেন আমার প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল।’ তার সঙ্গে নিজের দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি তো ছিলই।
ছেলেমেয়েদের বয়স পাঁচ হওয়ার পর আবার দেশের বাইরে পোস্টিং নেন সামিনা নাজ।
‘প্রথম’ সব কৃতিত্বের ঝুলি: মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বরত অবস্থায় সামিনাকে বলা হয় ভারতের মুম্বাইয়ে বাংলাদেশের একটি নতুন মিশন খোলার জন্য। ২০১৩ সালে সামিনা মুম্বাইয়ে প্রথম বাংলাদেশ মিশন অফিস খোলেন। তিনিই প্রথম নারী রাষ্ট্রদূত যার অধীনে কোনো নতুন মিশন অফিস খোলা হয়েছে।
এভাবেই সামিনার পেশাজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে এসেছে প্রথম নারী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের সুযোগ। পররাষ্ট্র ক্যাডারে নারীর সর্বোচ্চ অংশগ্রহণে প্রথম ব্যাচ, নিজ ব্যাচ থেকে প্রথম নারী রাষ্ট্রদূত, এরপর প্রথম নারী হিসেবে কোনো দেশে মিশন অফিস চালু করা… এছাড়াও মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সময় ২০০৮ সালে প্রথম নারী ‘ডেপুটি চিফ অব প্রটোকল ভিজিট’হন সামিনা। আবার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তরের প্রথম নারী পরিচালকও ছিলেন তিনিই। দেশে-বিদেশে ছুটোছুটি বেশি বলে নারীদের এই পদে নেয়া হয় কম। কিন্তু নিজ যোগ্যতা ও কাজের প্রতি আগ্রহ থেকে এই দায়িত্বও পালন করতে সফল হন সামিনা।
‘পড়ালেখা বা কর্মজীবন – কোনো ক্ষেত্রেই নিজেকে শুধু ‘মেয়ে’ হিসেবে ভাবিনি আমি। মূলধারায় সবাই যেভাবে কাজ করে সেভাবেই করেছি। এবং আমার সৌভাগ্য, নারী বলে কোনো ক্ষেত্রেই কোনো রকম অসহযোগিতা পাইনি আমি,’ বলেন সামিনা।
নতুন চ্যালেঞ্জ: মুম্বাইয়ে চার বছর দায়িত্ব পালনের পর চলতি বছরের জুলাইয়ে সামিনা নিয়োগ পান ভিয়েতনামের রাষ্ট্রদূত হিসেবে। ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার হওয়ায় বাণিজ্যসহ যে কোনো দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে অনেক বেশি ভেবেচিন্তে এগোতে হয়, যেন ভিয়েতনামের রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার কোনো দ্বন্দ্ব সৃষ্টি না হয়।
ভিয়েতনামের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়ানোর অনেক সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ। আর সেই বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ানোকে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন তিনি। তার ইচ্ছা, বর্তমানে প্রায় ৭শ’ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাংলাদেশ-ভিয়েতনাম দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যকে বাড়িয়ে শিগগিরই এক বিলিয়ন ডলারের করবেন।