মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের দুর্গম চরাঞ্চলে রাসেল ভাইপার (চন্দ্রবোড়া) সাপের আতংক দেখা দিয়েছে। এতে জমির ফসল তোলা ও গবাদি পশুর খাবার (ঘাস) সংগ্রহ করা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন চরাঞ্চলের কয়েক হাজার কৃষক। এতে উপজেলার পদ্মা তীরবর্তী এলাকা ও চরাঞ্চলের বসবাস করা মানুষ আতংকে রয়েছেন। একের পর এক বিষধর রাসেল ভাইপার সাপের দেখা মিলছে নদী তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায়।
সোমবার (৩ জুন) দুপুরের দিকে উপজেলার চরাঞ্চল লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নে ফসলের ক্ষেতে রাসেল ভাইপার দেখা যায়। পরে কৃষকেরা লাঠিসোঁটা দিয়ে সাপটি মেরে ফেলে। রাসেল ভাইপারের উপদ্রপে আতংকিত হয়ে পড়েছে চরাঞ্চলে কৃষকসহ বসবাসকারী কয়েক হাজার সাধারণ মানুষ।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মানিকগঞ্জের পদ্মা অধ্যুষিত নদীভাঙনের কবলে ৩টি ইউনিয়ন আজিমনগর, লেছড়াগঞ্জ ও সুতালড়ী ইউনিয়নের জেগে ওঠে। ফলে চরে প্রায় ৫০ হাজারের অধিক মানুষ বসবাস করেন। যাদের একমাত্র পেশা হলো কৃষিকাজ। কেউ কেউ নিজের জমি, আবার কেউ অন্যের জমি বছর চুক্তিতে কিনে চাষাবাদ, করেন।
চরাঞ্চলে শতশত বিঘা জমিতে ভুট্টা, বাদাম, তিল, আমন ও আউশ ধানের চাষ করা হয়। কিন্তু ফসলের জমিতে বিষধর সাপ রাসেল ভাইপার দেখা দেওয়ায় বিপাকে রয়েছে কয়েক হাজার কৃষক। গত তিন মাসের মধ্যে চরাঞ্চলে রাসেল ভাইপারের কামড়ে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।
সেলিমপুর চরাঞ্চলের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, কাঞ্চনপুর এলাকার চরে এক কৃষক তিল কেটে রেখে দেয়। পরে আঁটি তুলতে গিয়ে তিলের মধ্যে রাসেল ভাইপার দেখতে পায়। পরে মাঠ ছেড়ে চলে যান শ্রমিকরা।
শিকারপুরের সাইদুল মোল্লা বলেন, তার জমির ধানের আঁটি গাড়িতে তোলার সময় এক শ্রমিক রাসেল ভাইপার সাপ দেখতে পায়। পরে তার সঙ্গে থাকা অন্য শ্রমিকরা সাপটিকে মেরে ফেলে।
লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, আমার ইউনিয়নে গত মার্চে রাসেল ভাইপার সাপে কামড়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়াও পাশের ইউনিয়নের বসন্তপুর ও এনায়েতপুর এলাকায় দুই যুবককে সাপটি দংশন করে। এতে করে আমাদের চরাঞ্চলের আজিমনগর, সুতালড়ি ও লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নে পদ্মাপাড়ের লোকজন আতংকে রয়েছেন।
হরিরামপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তৌহিদুজ্জামান খান বলেন, হরিরামপুরের চরাঞ্চলে কৃষকদের ধান কাটার সময় সতর্কতার সঙ্গে ধান কাটতে হবে। প্রয়োজনে সাময়িকীর কৃষককে গামবুট পরে জমিতে কাজ করতে হবে। কৃষকদের মাঝে সচেতনতার জন্য প্রতিটি ব্লকে লিফলেট বিতরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
এদিকে রাসেল ভাইপার সম্পর্কে তরুণ বন্যপ্রাণী গবেষক এবং বাংলাদেশ বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা জোহরা মিলা জানান, রাসেল ভাইপার সাপটি ‘চন্দ্রবোড়া’ বা ‘উলুবোড়া’ নামেও পরিচিত। আইইউসিএনের ২০১৫ সালের লাল তালিকা অনুযায়ী রাসেল ভাইপার বাংলাদেশে সংকটাপন্ন প্রাণীর তালিকায় রয়েছে।
ধানক্ষেতে রাসেল ভাইপারের উপস্থিতি নিয়ে জোহরা মিলা বলেন, ইঁদুর ও টিকিটিকি রাসেল ভাইপারের প্রিয় খাবার। যেহেতু ফসলের ক্ষেতে ইঁদুরের উৎপাত বেশি তাই খাবারের খোঁজে ক্ষেতে গিয়ে হাজির হয় রাসেল ভাইপার। তাছাড়া বসতবাড়ির আশপাশে প্রাণী দুটির (ইঁদুর ও টিকটিকি) প্রাচুর্যতা বেশি থাকায় খাবারের খোঁজে রাসেল ভাইপার অনেক সময় লোকালয়ে চলে আসে এবং মানুষকে দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কখনো কখনো আক্রমণও করে।
জোহরা মিলা বলেন, পদ্মার চরাঞ্চল, নদী অববাহিকা ও বরেন্দ্র এলাকায় উঁচু-নিচু ঘাস বা ফসলের জমিতে এই সাপটি বেশি দেখা যায়। সাধারণত জুন-জুলাই মাসে এর প্রজননকাল। সাপটি ডিম দেওয়ার বদলে সরাসরি ৬-৬৩টি বাচ্চা প্রসব করে। দেখতে মোটা, লম্বায় ২ থেকে ৩ ফুট দৈর্ঘ বিশিষ্ট এই সাপের গায়ে ছোপ-ছোপ গোলাকার কালো দাগ থাকে। ঘন ঘন জিহ্বা বের করে হিসহিস শব্দ করে। সাপটি সম্পর্কে যার ধারণা নেই তিনি এটিকে অজগর ভেবেই ভুল করবেন।
জোহরা মিলা বলেন, এই সাপের বিষ ‘হেমোটক্সিন’ হওয়ায় মাংস পচেই আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হয়। সাপটির কবল থেকে বাঁচতে সচেতনতাই কার্যকর পথ। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ অনুযায়ী সাপটি সংরক্ষিত।